ইনজামামুল হক, নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
ভৈরব নদের বাঁকে গড়ে ওঠা শহর বাগেরহাটের বিস্তৃতি এখন দড়াটানা পর্যন্ত। শহর রক্ষা বাঁধ নামে পরিচিত নদী তীরের উঁচু রাস্তা ধরে চলতে এক পাশে শহর অন্যপাশে নদী, গ্রাম; শহরের পাশে সবুজের স্নিগ্ধতা।
তবে এমন স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হবার উপায় নেই। গত কয়েক বছর ধরে নদীতীরে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ভৈরব ও দড়াটানা নদী। অনেকে আবার এই সুযোগে কৌশলে তীরের জায়গা ভরাট করে দখলে নিচ্ছেন। ফলে ক্ষীণ হয়ে আসছে নদীর স্রোতধারা।
উত্তর দিক থেকে আসা ভৈরব নদের ধারা শহরের সুপরিপট্টি খেয়াঘাটে পাশ দিয়ে চলে গেছে পূর্ব দিকে। দক্ষিণে ভৈরব প্রবাহিত হয়েছে দড়াটানা নামে। নদের পশ্চিম তীরে বাগেরহাট শহরের প্রধান বাজার। এখান থেকে নদের তীর ধরে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকেই চোখে পড়বে ছোট-বড় অসংখ্য ময়লার স্তুপ।
সুপরিপট্টি ঘাট থেকে দক্ষিণে নাগেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন দড়াটানা নদীর পাড়ে পলি জমে চর জেগেছে। প্রাকৃতিক ভাবে ছোট ছোট কিছু গাছও জন্মেছিলো। কিন্তু সেখানে নদীর বুকে মাটি দিয়ে বান্দা (বাঁধ) দিয়ে ময়লা ফেলা হচ্ছে।
কারা এই ময়লা ফেলছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পৌরসভা থেকে ছোট ছোট ভ্যান আর ট্রাকে করে ময়লা এনে এখানে ফেলা হচ্ছে। দুর্গন্ধে আশপাশের লোকজন টিকতে পারে না।
দড়াটনা নদীর ভদ্রপাড়া খেয়াঘাটে নৌকা চালান পশের বৈটপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মাহাবুব হাওলাদার। ১৩ বছর ধরে এই ঘাটে নৌকায় করে যাত্রী পারাপারের করছেন তিনি। তাঁর পিতা গয়েজ উদ্দিন হাওলাদারও ছিলেন একই পেশায়। তবে মাহাবুব হাওলাদারের ভাবনা, ‘নদী আর থাকবে না; এই পেশায়ও আর থাকা যাবে না।’
তিনি জানান, আগে জোয়ারের সময় নদীতে ৪০-৪৫ হাত আর ভাটায় না হলেও ২০ থেকে ২৫ হাত পানি থাকতো। কিন্তু এখন ভাটির সময় অধিকাংশ যায়গায় পাঁচ হাত সাড়ে পাঁচ হাতের বেশি পানি থাকেনা। ১০-১৫ বা ২০ বছর পরে হয়তো এই নদীর হয়তো শুকায়ে যাবে।
‘আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে দুটো ব্রিজ। শহর ছাড়িয়ে যাত্রাপুরের কাছে নদী তো মরেই গেছে। চারপাশ থেকে দখল হচ্ছে। এই নদী বাঁচাবেন কি করে?’
দড়াটানা সেতুর নিচ থেকে শহর রক্ষা বাঁধ ধরে মুন্সিগঞ্জের দিকে এগোলে একটু পর পর চোখে পড়ে ছোট-বড় বহু ময়লার স্তূপ। কোথাও আগে ময়লা ফেলে ভরাট করা হয়েছে। কোথাও মাটি ভরাট করে তোলা হয়েছে স্থাপনা। দড়াটানা সেতুর অপর প্রান্তে চলছে বেড়িবাঁধের জন্য ব্লক তৈরির কাজ। সেখানেও বাঁশের পাইলিং করে নদের তীর দখল করা হচ্ছে।
বাজারের একমাত্র পশু জবাইখানাটি নদের তীরে। এর দক্ষিণে নদের অংশে ময়লা ফেলে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে এখন ট্রাক দাঁড় করানো হয়।বাজার থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত নদের তীরেও বর্জ্য ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু জায়গা দখলও হয়ে গেছে। দোকানঘর, কাঁচাবাজার, ডেকোরেটরের মালামাল ও ব্যবসায়ীদের দখলে গেছে পুরো তীর।
লঞ্চঘাট মসজিদের দুই দিকে নদের তীরে দেড় বছর আগেও ছিল গোলপাতা আর কেওড়াগাছের সারি। এখনো হাতে গোনা কয়েকটি টিকে আছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে দক্ষিণের একটি অংশ ভরাটের পর সেখানে মোটরসাইকেল পার্কিং করা হচ্ছে। উত্তরের অংশটি দখলে রয়েছে ডেকোরেটরের দোকানের। এরপর থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত পুরো নদের তীর কাঠ আর ইট ও বালু ব্যবসায়ীদের দখলে রয়েছে। তা ছাড়া শহরের প্রধান নালা থেকেও সরাসরি বর্জ্য যাচ্ছে নদে। এভাবে দূষণ ও দখলে নাকাল হচ্ছে ভৈরব নদ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সামছউদ্দীন-নাহার ট্রাস্টের চিফ ফ্যাসিলিটেটর সুব্রত কুমার মুখার্জি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর মতো দূষণ-দখলে অস্তিত্ব সংকটের পড়তে যাচ্ছে বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ। যত্রতত্র নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলায় ভৈবর নদের একাধিক স্থানে চর জেগে উঠেছে। আর এই চরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে অবৈধ স্থাপনা।
‘যে ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে বাগেরহাট শহরের গোড়াপত্তন; অব্যবস্থাপনা আর নিষ্ঠুরতায় সেই ভৈরবই এখন জৌলুশ হারাচ্ছে। অব্যাহত দূষণ ও ভরাটের কারণে দিনে দিনে মরা খালে রূপ নিচ্ছে।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বাগেরহাট জেলা শাখার সভাপতি রামকৃষ্ণ বসু বলেন, ‘আমাদের নদ-নদীগুলো আগের চেয়ে অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। নাব্য সংকট চলছে। শিগগির খনন করা দরকার। আর দখলদারমুক্ত রাখা দরকার।’
বাগেরহাট পৌরসভার মেয়র খান হাবিবুর রহমান বলেন, ময়লা ফেলার জন্য পৌরসভার নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। তাই মানুষ নদের তীরে ময়লা ফেলছে। তবে এই অবস্থা খুব বেশি দিন থাকবে না। পৌরসভার ময়লা ফেলার জন্য জায়গা কেনার প্রক্রিয়া চলছে। উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন সময়ে নদ খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আছে।
বাগেরহাটে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমরা দখল ও দূষণ রোধে কাজ করছি। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের মাসিক উন্নয়ন সভায়ও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নদী দূষণ রোধে পৌরসভার আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য পাঁচ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। তা ছাড়া অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আসছে।
অবৈধ দখলদারদের তালিকা করতে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বলা হয়েছে। তালিকা পেলেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এইচ//এসআই/বিআই/৮ এপ্রিল, ২০১৭
** দূষণ-দখল বাড়ছেই: সংকটে ভৈরব